একটা সুন্দর ও মনোরম অক্টোবরের সকাল, দিনটা ছিল মহাসপ্তমী।
সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পৌছলাম ৪,টোটে লেনে।আমাদের ভ্রমণ উপদেষ্টা'ট্যুর দ্য সুন্দরবনস' ই এই জায়গাটির পরামর্শ দিয়েছিলেন ২দিন ১ রাত্রি ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, সুন্দরবন ট্রিপের জন্য।
চেক বুকিং, পেমেন্ট এবং বাকি টাকা জমা দেওয়ার সমস্ত নিয়মকানুন উপদেষ্টা করেছিলেন। এরপর দারুণ গরমাগরম লিকার আদা চা খাওয়া হয়েছিল।তারপর সেখান থেকে কিছু মিটার দূরে পার্কিং থেকে টেম্পো ট্রাভেলার বুক করে নিতে বলা হল আমাদের।
আমাদের অন্যান্য সহযাত্রীদের মধ্যে ছিল এক জোড়া পরিবার এবং কিছু পর্যটক যারা ম্যাঞ্চেস্টার এবং ফ্রান্স থেকে এসেছিলেন। কিছু দূরেই অফিস থেকে আমাদের গাইড এম.জে আমাদের সাথে যোগ দিলেন।
সকাল ৮.২০ নাগাদ রেড রোড এবং মাও ফ্লাইওভার পেরিয়ে কলকাতা ছাড়লাম।
টেম্পোতে টোটে লেনের ব্যাকপ্যাকারস অফিসে তৈরী টাটকা ভেজ স্যান্ডউইচ এবং কলা পরিবেশন করা হল আমাদের।
টানা তিন ঘন্টা চলার পর আমরা শেষ প্রান্তএ পৌছালাম। যেটা আমি বলতে চাইছি সেটা হল গাড়ির রাস্তা এখানেই শেষ, এই জায়গাটির নাম হল গাদখালি। এখান থেকে আমরা একটা ফেরী নিলাম যেটা আমাদের পৌছে দিল সাতজেলিয়া গ্রামে আমাদের ইকো রিসর্টে।
মাটির কটেজ গুলো আমাদের দেখানোর পর আমরা এক ঘন্টা সময় পেলাম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হবার জন্য এবং তারপর আমরা মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম। খাবার গুলো রান্না করেছিলেন রিসর্টে কর্মরত গ্রামেরই এক মহিলা।খাবার গুলো ছিল অসাধারণ এবং সুস্বাদু, বাড়ির রান্নার আস্বাদ ছিল তাতে। রান্নাগুলোতে ঝালের পরিমাণ খুব কম ছিল যাতে আমাদের সুবিধেই হয়েছিল।
দুপুরের খাবারের পর আমরা পায়ে হেটে সাতজেলিয়া গ্রাম টা ঘুরে দেখতে গেলাম।এটি অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটি গ্রাম এবং গ্রামের লোকগুলো খুব মিশুকে এবং উপকারী।
নোনা জল জাতে গ্রামে ঢুকে শস্য নষ্ট এবং বন্যা তৈরী করে ঘর বাড়ি নষ্ট না করতে পারে তার জন্য গ্রামবাসী রা একটা বাঁধ তৈরী করেছেন, সেটাও আমরা পায়ে হেটে দেখলাম। ভাটার কারনে সুন্দরী( হেরিটিয়েরা লিট্টোরালিস ) গাছ গুলির শ্বাসমূল গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
একটা হাতে টানা নৌকা আমাদের জন্য ঘাটে অপেক্ষা করছিল। হেটে বেড়ানোর পর কয়েক ঘন্টা কাটানোর জন্য আমরা ওই নৌকা তে উঠে পড়লাম।ঘুরে দেখলাম স্থির নদীটি।আমাকে আপনাদের কল্পনার উপরই ছেড়ে দিতে দিন যে সন্ধ্যের আলোতে কেমন লাগবে এই জায়গাটি দেখতে। হ্যা, আপনারা ঠিকই বুঝছেন, শব্দ দিয়ে এই মূহুর্তকে বর্ণনা করা যায় না।
এই জায়গাটাটিতে নৌকা বা পর্যটক দের খুব একটা ভিড় নেই।এই জায়গাটি ভীষণ শান্তি দেয়।একইসাথে মনে হবে যেন সম্পূর্ণ জায়গাটির আপনার।
প্রায় দুঘণ্টা হাতে টানা নৌকা তে চড়ে আমরা আমাদের রিসর্টে ফিরলাম। এসে গরমাগরম বেগুনি আর আদা চা খেলাম।
এরপরে যা ঘটল তা হল সেইদিনের আসল চমক। হ্যারিকেন বাতিতে ঘেরা এক ছোট্ট 'ছাউনি' তে গ্রামবাসীরা লোকসংগীত পরিবেশন করলেন।প্রায় দুঘণ্টা এই সংগীত শোনার পর আমাদের রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছিল।
যদিও রাত্রে হাতে টানা নৌকাতে একটা সাফারির আয়োজন করা হয়েছিল তবুও আমরা আর যাইনি। কারণ একটা লম্বা দিনের ক্লান্তি ছিল আর তার উপর পরের দিন সকাল ৬ টার সময় আমাদের আবার যাত্রা শুরু করতে হত। আমাদের গ্রুপ থেকে কিছু পর্যটক চেয়েছিলেন রাতের ওই সাফারির অভিজ্ঞতা করতে। তারা ফিরেছিলেন রাত্রি ১০.৩০ এর সময়।তাই আমি ভাবলাম যে এটা করাই যেত। আমাদের জন্য ওই সংগীত ও রাতের খাবারই আমাদের উপর শেষ দীর্ঘ প্রভাব ফেলেছিল।
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আমরা ৬ টার সময় সবাই একত্রিত হলাম। তারপর ফুটন্ত চা খেয়ে সবাই ফেরী তে উঠে পড়লাম, যা আগামী ১২ ঘন্টার জন্য আমাদের বাসস্থান হতে চলেছে। নৌকাগুলিতে প্রাথমিক শৌচাগার এর ব্যবস্থা ছিল। আশা করি এই ব্যবস্থা টা আমাদের নৌকাভ্রমণ এর সময় নিয়ে আপনাদের মনে যে সংশয় এর তৈরী করেছিল তার উত্তর দিল।
ফেরী রওনা দিল এবং কিছুদূর গিয়ে এক দ্বীপ থেকে আমাদের জন্য কিছু জিনস ও এবং রাঁধুনিদের নৌকাতে তুলে নিল এবং তারপর শুরু হল আমাদের সেই দিনের যাত্রা। নৌকাতেই আমাদের প্রাতঃরাশ পরিবেশন করা হল।
একজন সরকার নিযুক্ত গাইড সজনেখালি থেকে আমাদের ফেরীতে উঠলেন। তিনি ওই গোটা দিনের জন্য এম.যে র সাথে আমাদের গাইড হলেন।সরকার নিযুক্ত নির্দেশক প্রতিটি ফেরী তে থাকা আবশ্যক।আবার বিদেশী পর্যটক দের জন্য অনুমতি লাগে। যা এম.যে সুরক্ষিত করেছিলেন আমাদের সাথে যে বিদেশী পর্যটক ছিলেন তাদের জন্য।
নৌকাটি বাঁক দিয়ে গভীর সুন্দরবনে প্রবেশ করল এবং আমাদের নিয়ে গেল জনশূন্য সংরক্ষিত বনে।আমরা অনেক বন্যপ্রানী দেখতে পেলাম- পাখি,মনিটর টিকটিকি এবং কুমির।
দুপুরের খাবার নৌকাতেই পরিবেশন করা হয়েছিল।আমরা দুটো ওয়াচ টাওয়ারে নেমেছিলাম দ্বীপগুলির আশপাশ টা( নিয়ন্ত্রিত এলাকা) ঘুরে দেখার জন্য। দশ ফুটের রাস্তা নির্দিষ্ট আছে ঘুরে দেখার জন্য।
সরকার নিযুক্ত নির্দেশক টি খুব উপকারী ও মিশুকে ছিলেন।
কিছু তথ্য :
সুন্দরবন হল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। এটির ৬০% আছে বাংলাদেশে এবং ৪০% ভারতে, ভারতে এটির প্রায় ৪০০০ বর্গ কিলোমিটার আছে ।
ভারতে মোট দ্বীপ এর সংখ্যা ১০০ এরও বেশী এবং এই সকল দ্বীপ এর ৫০%-৬০% দ্বীপে মানুষ বসবাস করে।
শেষ পরিসংখ্যা অনুযায়ী রয়্যাল বেংগল টাইগারের সংখ্যা ছিল ১০৬( বাঘের বাচ্চা সমেত) তারা স্বাধীন ভাবে ভারত ও বাংলাদেশ প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়, তাই নির্দিষ্ট সংখ্যাটি বলা কঠিন।
No comments:
Post a Comment